দুনিয়ার এক প্রান্তে সাগরপাড়ের গোপন পুরে বাসা বেঁধেছিল Wurundjeri সম্প্রদায়। ঠিক কবে তা যদিও লুই বলতে পারল না। উত্তরের পাহাড় থেকে দক্ষিণে ইয়ারা নদীর পাড় অবধি ছড়িয়ে ছিল তাদের গৃহস্থালি। লুইয়ের ঠাকুরমার বয়েস এখন ৯৮ – থাকেন মেলবোর্ণের থেকে সামান্য দূরে – পাহাড় চূড়ার ঘর আগলে। লুইয়ের বক্তব্য – “গোটা মেলবোর্ণ শহরটা দাঁড়িয়ে আছে আমাদেরই পূর্বপুরুষের জমির ওপর।” জমির স্বত্ব হারাতে হারাতে এখন ওইটুকুই পড়ে আছে ওদের।
লুই এসেছিল আমাদের সম্মেলনে তার লড়াইয়ের গল্প বলতে। অস্ট্রেলিয়ার অন্যান্য লুপ্তপ্রায় উপজাতির মতই Wurundjeri রাও এখন সংখ্যায় কমতে কমতে ছ’শো জনে এসে ঠেকেছে। ওর ইংরাজি শুনে কে বলবে যে ও Woiwurrung ভাষাতেও সমান দক্ষ।
আজীবন কত লড়াই যে লুই করেছে এই Woiwurrung ভাষা ও Wurundjeri শিল্প সংরক্ষণের জন্যে! কিন্তু করলে কি হবে! ওই ছ’শো জনের মধ্যে কজনই বা ভাষা জানে বা বলতে পারে! লুইয়ের নিজের খুড়তুতো – মামাতো ভাইবোনেরাই তো সব ইউনিভার্সিটিতে পড়ে সাহেব হয়েছে!
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ঠিক কবে এই ভূখণ্ডে পা রেখেছিল – তার কোন যথাযথ হিসেবনিকেশ নেই! কেউ বলে ৬০০০০ বছর আগে – কেউ বলে ৭০০০০। ৩০০০০ বছর পুরনো কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষী-সাবুদ পাওয়া গেছে – পাওয়া গেছে তাদের শিল্পকলার নিদর্শন। আদিবাসী শিল্প যেমন হয় – মাটির গন্ধ মাখা – জীবনের জলছবি।
লুই বলল Aboriginal Art নামে যে বিন্দু বিন্দু রং দিয়ে আঁকা ছবির আজকাল রমরমা বাজার – তা আদিবাসীদের আদত অঙ্কনশৈলী নয়। এটা হ’ল Bardon সাহেবের কীর্তি। সত্তরের দশকে সাহেবের ওপর দায়িত্ব পড়েছিল Wurundjeri বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখানোর। সাহেব লক্ষ্য করেছিলেন এই সম্প্রদায়ের দাদু-বাবা-কাকারা ছোটদের গল্প বলতে বলতে মাটিতে ছবি আঁকে – পাহাড়, নদী, গাছ, পশু, পাখি। তিনি ওদের বললেন মাটিতে না এঁকে ক্যানভাসে আঁকতে।
পশ্চিমী আধারে ছবি আঁকতে গিয়ে তো Wurundjeri শিল্পীরা পড়লেন মহা ফাঁপরে। তাদের সব ছবিতেই গল্প থাকে – সেই সব গল্প তাদের জীবনের গল্প – তাদের পূজা-পার্বনের গল্প – তাদের সমাজের গল্প – সেই সব কথা কি হাটে-বাজারে বলা যায়! তাই নাকি তারা এক উপায় ঠাওরাল। গল্পটা এঁকে প্রতীকী চিহ্নগুলোকে তারা ঢেকে দিত বিন্দু বিন্দু রঙের গোলার আড়ালে। পাহাড় – গাছ – শিকারি – সবই রইল – কিন্তু আভাসে ইঙ্গিতে, ছায়াময় ভাষায় উজ্জ্বল রঙের মোড়কে – যা কিনা পরবর্ত্তিকালে হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত আদিবাসী ধারার শিল্প। উজ্জ্বল রঙসজ্জায় সে ভারী আকর্ষনীয়! আমি তো প্রতিবার ব্যাগ বোঝাই করে নিয়ে আসি প্লেট, ট্রে, ফুলদানি, কাঠের হাতা, কোস্টার।
লুই ও তার সহকর্মীদের অক্লান্ত অধ্যাবসায়ে সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রীয় গ্যালারিতে Aboroginal Art এর বিভাগ হয়েছে। লুই আমাদের আমন্ত্রণ জানালো সেখানে যেতে। আর আমাদের ডিনার পার্টি ছেড়ে যাবার আগে সে আমাদের জন্যে রেখে গেল একরাশ gum tree বা অস্ট্রেলিয়ান ইউক্যালিপ্টাসের পাতা – আন্তর্জাতিক গোষ্টিকে Wurundjeri সম্প্রদায়ের সবুজ শুভেচ্ছা।
ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা এই সব আগেই পশ্চিম অস্ট্রেলিয়াতে দেখেছি প্রাণ ভরে – তাই এবার মেলবোর্ণে পা দিয়েই আমি আমার সহকর্মী আবীরকে নিয়ে রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন্স ঘুরে এসেছি। South Yarra র পাড় ধরে আমরা হেঁটেছি মখমলি ঘাসে পা ডুবিয়ে। রাস্তা পেরোলেই মেলবোর্ণ ক্রিকেট গ্রাঊণ্ডের কিংবদন্তীর মাঠ। দলের অনেকেই গেল তাকে সরেজমিনে দেখতে। আমি অবশ্য এ পাড় থেকে ছবি তুলেই ক্ষান্ত।
শীতের সকাল। আকাশে মেঘের ধূসর চাঁদোয়া। রাস্তার দুপাশ জুড়ে পত্রবিহীন গাছের সারি। মেপলের খয়েরী পাতা ভেসে বেড়াচ্ছে দক্ষিনী বাতাসে। আমরা ইয়ারা নদীর ধার দিয়ে পাথরকুচির জঙ্গল ধরে হাঁটছি চাইনীজ গার্ডেনের ভেতর দিয়ে। সারা বাগান জুড়ে অদ্ভূত এক রূপোলী শৈত্য। ধূসর পাথরকুচির পাতাগুলি যেন মখমলে মোড়া। সেই রূপোলী শৈত্য অগ্রাহ্য করে দুষ্টু বাচ্চার মত উঁকি মারছে দু এক কলি বেগুনি, লাল, সাদা, হলুদ ফুল।
হাঁটতে হাঁটতে সাঁকো পেরিয়ে একসময় আমরা ঢুকে পড়ি Australian Bell Miner এর সাম্রাজ্যে। অলিভ-সবুজ পালক তাদের – কিঁক – কিঁক করে হুইসল বাজাতে বাজাতে – তুরুপ তুরুপ করে ডালে ডালে নেচে নেচে মেঘ-রোদ্দুরের সাথে লুকোচুরি খেলছে তারা। এখানে বাগান জুড়ে নানা প্রকার গাম ট্রি – বা ইউক্যালিপটাস। তাদের কিছু কিছু এই মাটির সন্তান – কিছু কিছু এসেছে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে।
ওদিকে জলে সাঁতার কাটছে এক জোড়া কালো রাজহাঁস – তাদের টুকটুকে লাল ঠোঁট। এক ঝাঁক কালো হাঁসও ডুব সাঁতার দিচ্ছে। জলের ধারে ফুটে আছে আগুন-রাঙ্গা মরুফুল – Banksia brownii। এদের দেখেছি ঝোপে ঝাড়ে ফুটে থাকতে সর্বত্র – নানা রূপে। তাদের প্রতিচ্ছবিতে আগুন লেগেছে জলের বুকে। ঘোর কমলার সাথে বেগুনি মিশিয়ে স্বর্গের পাখীর মত বাগান আলো করে ফুটে রয়েছে যত্র তত্র Birds of Paradise. ফুলবিহীন পাতাবাহার গাছেরাও উৎসবে যোগ দিয়ে পাতার মুকুটে লাগিয়েছে বাসন্তী রং।
অসীম মুগ্ধতায় আমরা হেঁটেই যাচ্ছি – প্রায় মাইল তিনেক হাঁটার পর যখন আমরা পৌঁছলাম বাগানের অন্য প্রান্তে – দেখি সেখানে আমাদের সব ক্লান্তি শুষে নিতে প্রস্তুত অগণিত ক্যামেলিয়ার উজ্জ্বল উচ্ছ্বাস। কখনো তারা সদ্য-স্নাতা স্নিগ্ধ নিরাভরণার মত শ্বেত-সুন্দরী – কখনো ষোড়শীর কপোলে লেগে থাকা গোপন গোলাপী অনুরাগ, কখনো নতুন আঙ্গিনায় প্রবেশকালে নববধূর কড়ে আঙ্গুল ছোঁয়ানো দুধে-আলতা, আবার কখনো তারা গরবিনী বধূর উজ্জ্বল সিঁদুরে-রাঙ্গা উন্মুখ আকাঙ্ক্ষা।
দেখে তো আমরা পাগল!
নানা angle থেকে বন্দী করার চেষ্টা করি তাদের রূপ – কিন্তু সেই ঢলোঢলো রূপের সম্ভার কি আর স্থবির দুই মাত্রায় ধরা যায়!
এদিকে দিন প্রায় ঢলে পড়ছে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমেছে তখন। ঠিক করি অস্ট্রেলিয়ান রেন ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে এক চক্কর ঘুরে সেদিনের মত বেরোব। এদিকে ওক – গাম – ঝাঊ এর ভিড় – বেশ কিছু প্রজাতি যেমন অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব – তেমনি রয়েছে বেশ কিছু গাছ যা এসেছে ইয়োরোপ, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা থেকে – উপহারে পাওয়া সম্প্রীতির প্রতীক। এই সম্প্রীতির গল্প অস্ট্রেলিয়ার নিজস্ব ইতিহাসের মতই জটিল – রক্তাক্ত – অথচ বহু সূর্যুমুখী জীবনের গল্পের মতই আলোকময়।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের উল্টোদিকেই Shrine of Remembrance. প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের উদ্দ্যেশ্যে নির্মিত মনুমেন্ট। তাদের স্মৃতির উদ্দ্যেশ্যে জ্বলতে থাকা অনির্বাণ দীপশিখায় হাত পা গরম করে আমরা ফিরে আসি ইয়ারা নদীর পাড়ে। ফুলের ঘড়িতে সময় বিকেল চারটে-দশ। মেঘের ছায়া অঙ্গে ধরে নদীর জল কাজল কালো।
সকালের কফি আর রোল তখন হজম হয়ে খিদে পাচ্ছে। খানিক খোঁজাখুঁজি করে খেতে খেতেই দেখি নীলচে সন্ধ্যা নামছে শহরের বুকে। আলো জ্বলে উঠছে আকাশচুম্বী অট্টালিকাগুলিতে। রং-বেরঙ্গী আলোর মালায় সেজে দুঃখ-ভেজা মেঘলা নদীটা নতুন প্রাণে জেগে উঠছে দিনের শেষে। কৃষ্ণকলি নদীর অপরূপ রূপে ভুলে সারাদিন কেড়েকুরে খাওয়া সাদা পাখীগুলো উড়ান ভুলে হঠাৎ থমকে বসে গেল তার পাড়ে।
খানিক আগেও আমার ক্লান্ত পাগুলো আর চলতে চাইছিল না।
তবুও যখন আবীর বলল – “চলুন ভিক্টোরিয়া মার্কেট ঘুরে আসি” – আমিও সম্মোহিত হয়ে উঠে পড়লাম ট্রামে।
টুং টুং করে ট্রাম চলল শহরের অন্য প্রান্তে।
নেমে দেখলাম দোকানবাজার সব বন্ধ হয়ে গেছে। বিকেল পাঁচটাতেই সব বন্ধ হয়ে যায় এখানে। আবীর কাঁপছে তীব্র শীতে। ওর ইচ্ছে ছিল একটা জ্যাকেট কিনবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পৌঁছে গেলাম Winter Night Market এ। সেখানে খাবারের দোকানের মেলা। স্প্যানিশ, ইটালিয়ান, চাইনিজ, পোর্তুগীজ, গ্রীক – সব খাবারের দোকানের সামনেই দীর্ঘ লাইন। বিদেশে বসে দেশী স্বাদের জন্যে আকুলতা টেনে আনছে শয়ে শয়ে মানুষকে।
আমাদের পেট ভরতি।
তাই মার্কেটের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত মানুষের ঢলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে – তাদের হাতের খাবার দেখে – তাদের ভিন্ন ভাষার কথা শুনে – মনে মনে কিছু গল্প বুনে বিবিধের মাঝে মহামিলনের আস্বাদ নিলাম কেবল।
পরের দিন সকালে উঠে দেখি মাটিতে পা ফেলতে পারছি না প্রায়। আগের দিন খেয়েছি যদিও একটা পেইন কিলার – তবু আরো একটা খেয়ে – বাকিগুলো ব্যাগে নিয়ে বেরোলাম কনফারেন্সের উদ্দ্যেশ্যে। আমার হোটেল থেকে পৌনে এক মাইল হেঁটে – পাঁচশ মিটার ট্রামে গিয়ে – আবার খানিক হেঁটে – তবে ইউনিভার্সিটি। যে Business District ঘিরে মেলবোর্ন শহরের জীবনটা আবর্তিত হয় – সেটা একটা চতুষ্কোন। তার এক প্রান্তে থাকি আমি – অন্য প্রান্তে কনফারেন্স। আবীর থাকে তৃতীয় বাহুতে – যেখান থেকে মোটামুটি সবই সম-দূরত্বে। বিজনেস ডিসট্রিক্টের মধ্যে ট্রাম ফ্রি।
কনফারেন্সে সকালে-দুপুরে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা খাবার খেয়ে আরো একটা পেইন কিলার খেয়ে লাঞ্চের ব্রেকে আবীরের জ্যাকেট কিনতে গেলাম ভিক্টোরিয়া মার্কেটে। এখন বাজারে টোম্যাটো, লেটুস, গাজর, ড্রাগন ফ্রূট, টোফু, ক্যাঙ্গারুর মাংস, চীজ এই সব বিক্রি হচ্ছে। নাইট মার্কেট যেখানে বসেছিল – সেখানে এখন সোয়েটার- স্যুভেনীর ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। জ্যাকেট কিনে আমরা আবার ফিরি ইউনিভার্সিটিতে।
সন্ধ্যেবেলায় কনফারেন্সের রিসেপশনে ছিল অঢেল শ্যাম্পেন, ওয়াইন আর বিয়ার। সঙ্গে নানা দেশের নিরামিষ স্ন্যাক্স – চীজ আর স্পিন্যাচ এম্পানাডা, ভারতের বেসনের ধোকা, বীনস ক্রোকে, লেমন ক্রেপ ইত্যাদি। আর ছিল লুইয়ের গল্প।
গল্পটা খুব চেনা চেনা।
আদিবাসী জীবনচর্যা সংরক্ষণ আর তাদের প্রগতির পথে টেনে নিয়ে যাওয়া – এই দুইয়ের বিরোধটা খুব পরিষ্কার। তাদের শিল্প ও সংস্কৃতি লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত করে রাখাটা তাই খুব জরুরি।
একটা শহরের রাস্তায় হেঁটে, তার সমুদ্রতীরের হাওয়া গায়ে মেখে শহরটাকে খানিক চেনা যায় ঠিকই – কিন্তু সেই পরিচিতিটা সম্পূর্ণ করতে তার ইতিহাসটাকে জানতে হয়। লুইয়ের গল্পটা আমায় উসকে দিল। ঠিক করলাম বহুভোগ্যা অস্ট্রেলিয়ার এই শহরের বিবর্তনের ইতিহাসটা জানতে একদিন একটু সময় বার করে যেতেই হবে Immigration Museum এ।
(ক্রমশ)