gallery কাঁঠালের পাটিসাপটা

লিপিকা দে

ইমেইল খুলতেই এইচ আর এর বিজ্ঞপ্তিটা আবার চোখে পড়ল জয়িতার। বছরশেষের উদযাপনে অখাদ্য-কুখাদ্য খাওয়া কর্মীদের স্বাস্থ্যরক্ষার্থে  নতুন বছরের শুরুতেই পালিত হবে  “হেলদিফীল” পক্ষ। অফিসের  সকলকে আহ্বান জানানো হচ্ছে সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর খাবারের রেসিপি তার উপাদান, তথ্য, ইতিহাস, ভূগোল সমেত ছবিসহ আপলোড করতে। রেসিপি বিচার হবে তিনজন বিশেষজ্ঞ ও জনগণের যৌথ ভোটে। ব্যক্তিগত পুরষ্কার ছাড়াও, যে প্রোজেক্ট থেকে সবচেয়ে বেশি রেসিপি প্রথম দশের মধ্যে থাকবে, সেই প্রজেক্ট লীডারও পুরষ্কৃত হবে। ক্লায়েন্টরা আজকাল স্বাস্থ্য সচেতনতা চাইছে। টীমের কর্মক্ষমতা ও প্রাণচঞ্চলতা নির্ধারণ করার জন্যে এইসব নাকি জরুরী। ফলে টীমে সবার ওপরেই চাপ আসছে রেসিপি পোস্ট করার।

ওদের এই “রাসেল” টীমের রুচিরা, সোমক, মহুল, রিনিকা বেশ কয়েকটা স্যালাড, স্যুপ এর রেসিপি পোস্ট করেও ফেলেছে। মহুল তো ওদের সবাইকে কাল লাঞ্চ টেবিলে পাতলা মুগের ডালের “গোল্ডেন লেন্টিল স্যুপ” পরিবেশন করে, চুমুক দেওয়ার ছবিটবি তুলে পোস্ট করল কোম্পানির সোশ্যাল মিডিয়াতে।  জয়িতার ওপর চাপ বাড়ছে। মহুল ওর থেকে দু বছরের জুনিয়র। রোজ জিমে যায়। কাজেকম্মেও মন্দ না। আজ ক্লায়েন্ট যা খাচ্ছে – কাল কোম্পানিও তা খাবে। অয়েলফ্রী মুগের ডাল আর ধনেপাতা বাটা মাখানো বেকড রাঙা আলু খেয়ে ক্লায়েন্ট  খুশি হলে, পরের প্রোমোশনে মহুল ওকে টপকে চলে যেতে পারে ওপরে।  

জয়িতাদের টীমলীডার অর্ণব ঘোষ লোক খারাপ না। উদার মনের মানুষ। কাজেও ভালো। এফিশিয়েন্ট কোড, বেস্ট ওয়েবসাইট ডিজাইন – এইসবের জন্যে ওদের টীম আগে অনেক প্রাইজ-টাইজ পেয়েছে। কিন্তু গতবছর থেকে হঠাৎ ফোকাসটা নন-টেকনিক্যাল দিকে চলে যাওয়াতে অর্ণব নিজেও বেকায়দায় পড়ে গেছে।  সেই ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে একটানা পনেরো বছর ধরে অর্ণবকে টেক্কা দেওয়ার  চেষ্টা চালাচ্ছে সুদীপ্ত চৌধুরী। যদিও কলেজ জীবনে তাকে অল রাউণ্ডার মেড্যাল থেকে শুরু করে কলেজের সেরা সুন্দরী সব কিছুই সারেন্ডার করতে হয়েছিল অর্ণব ঘোষের কাছে, তবু সে হাল ছাড়েনি।  চাকরিতে ঢুকেও সেই পরম্পরা জারি ছিল। এটলাস আর রাসেলের প্রতিযোগিতা ক্যান্টিনের বিস্বাদ খাবারের সাথে চাটনির কাজ করে।  

যদিও দেশে সুন্দরীর অভাব নেই দুনিয়ায়, তবু বিয়ে করেনি সুদীপ্ত। বছর কয়েক আগে থেকে আবার জিমে যাওয়া শুরু করেছে। একসময়ে দুজনেই কলেজের বাস্কেটবল টীমে খেলেছে। তবে কলেজের পর আর মাঠে যায়নি অর্ণব।  সুদীপ্ত আর কি কি করছে সে খবরও রাখেনি। হঠাৎ গত বছর এনুয়াল ডের দিন ওর মাথায়  বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো যখন সুদীপ্ত চৌধুরীর নাম ঘোষিত হলো  তিন তিনটে ক্যাটেগরিতে বেস্ট হেলদী রেসিপির বিজেতা হিসেবে। এর পর বেস্ট টীম ঘোষণা করার আগেই হল ফেটে পড়ল করতালি আর “এটলাস এটলাস” উল্লাসে।বিপুল করতালির মধ্যে সুঠাম চেহারার সুদীপ্ত চৌধুরী যখন তার দলবল নিয়ে স্টেজে উঠল – উত্তেজনায় অর্ণবের বৌ ঋতার হাত থেকে অরেঞ্জ স্কোয়াশ মিশ্রিত স্ক্রু ড্রাইভার ছলকে পড়ল ওরই অফ হোয়াইট তসর জামদানিতে। আঁতকে উঠে অর্ণব চু চু করে সমবেদনা জানাতে গিয়েছিল। ঋতা ওর দিকে অপাঙ্গে তাকিয়ে বলল – “সুদীপ্তদা এরকম দুর্দান্ত বডি মেইন্টেইন  করেছে বলোনি তো তুমি!”

“কেন? জানলে কি করতে? অপ্সরা হয়ে ওর ধ্যান ভঙ্গ করতে যেতে?” 

“না মশাই। তোমাকেও ঠেলে পাঠাতাম এই ডিসগাস্টীং নোয়াপাতি ভুঁড়িটা কমাতে”, বলেই খালি গ্লাসটা ওর হাতে দিয়ে বলে – “কাল থেকে তুমিও  জিমে যাবে বুঝলে! এখন আমাকে আরেকটা ড্রিঙ্ক এনে দাও দেখি।” 

এবার তাই পুজোর পর থেকেই অর্ণব টীমের সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছে নতুন নতুন রেসিপি ট্রাই করতে। লাঞ্চ টেবিলে আজকাল নিত্যনতুন চমক অপেক্ষা করে। উৎসাহী  যুবক যুবতীরা প্রায়ই গ্লুটেন ফ্রি কেক, মিলেটের মালপোয়া, রাগী মুরুক্কু, বেকড শিঙাড়া – নানা জিনিস বানিয়ে আনছে। গম্ভীর চর্চা হচ্ছে এদের খাদ্যগুণ নিয়ে। অর্ণব চাইছে জয়িতা এই কন্টেস্টে অংশ নিক। জয়িতা টীমের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও ধীময়ী মেম্বার। গোটা কতক ক্লায়েন্ট টেস্টিমনিও আছে। প্রচুর স্টার-ফার পেয়েছে আগে। তবু সাবধানের মার নেই। মহুলের সাথে পাল্লা দিতে হলে রান্নাবান্নার দিকটাও ক্লীয়ার রাখা ভালো।

জয়িতার হয়েছে মহা বিপদ।  ভেবে ভেবে রাতের ঘুম চলে যাচ্ছে। ওর রান্নাঘর সামলায় কবিতাদি।কচুর লতি, এঁচোড়, চিতল মাছের মুইঠ্যা, কাঁটা চচ্চড়ি  – গোটা নিউটাউন চষে ফেললেও নিত্য এইসব রান্না হয়, এমন দ্বিতীয় রান্নাঘর খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। কবিতাদির প্যাশন রান্না করা – জয়িতা আর ওর বর রমিতের প্যাশন খাওয়া।

রমিত একটা ডিজাইন ফার্মে চাকরি করে। এক বইমেলায় আলাপ হওয়ার পর, দীর্ঘ প্রেমপর্বের উপসংহার টানার সময়ে, বছর সাতেক আগে দুজনেই এই বোধে উপনীত হয়েছিল যে – একটি সুস্থ সম্পর্ক ছাড়াও মাছের ঝোল, পোস্তর বড়া, মোচা ঘণ্ট, এগ রোল এইসব ওদের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে সচল রাখার জন্যে অত্যন্ত জরুরি।  কবিতাদির ইচ্ছে ইন্দুবালার মতো একদিন নিজের ভাতের হোটেল খুলবে। এখন হাত পাকাচ্ছে। 

অর্ণব জয়িতাকে বলেছিল কবিতাদির রান্না করা  দু একটা পদই না হয় পোস্ট করে দিক। এথনিক বেঙ্গলি বলে আলাদা পয়েন্ট পেতে পারে। কিন্তু স্বপ্নপুরণের পথ মসৃণ রাখার জন্যে রান্নায় সর্ষের তেলের ব্যবহারে কোন কার্পণ্য করে না কবিতাদি। আড়াইজনের একবেলার রান্না করতে মাসে পাঁচ কেজি তেল লাগে ওদের। খেয়ে পাঁচ বছরের মিঙ্কিও হাত চাটে। তবে সেই রান্নাঘর থেকে কিছু তুলে প্রতিযোগিতায় পোষ্ট করার প্রশ্নই ওঠে না। 

লাঞ্চের পর দুপুরে মন দিয়ে একটা কোড ডিবাগ করছিল জয়িতা। অর্ণব ওর ডেস্কে এসে দাঁড়াতেই, উত্তেজিত হয়ে বোঝাতে গেল যে ঠিক কি কারণে কোডটা এক জায়গায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে, সেটা ও ধরে ফেলেছে। অর্ণব সব শুনে গম্ভীরভাবে  বলল – “বাঃ। বোঝাই যখন গেছে,  তুই এক্ষুণি মহুল আর রিনিকাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে কি করতে হবে বলে দে। আজ চোদ্দ তারিখ।  তুই বরং বাড়ী গিয়ে একটু রান্নাবানা কর। কাল রাত বারোটার মধ্যে হেলদিফীলে পোস্ট করতে হবে। সবাইকে প্রাইজ পেতে হবে এমন কোন কথা নেই। পার্টিসিপেশনটাই জরুরি।”     

সেই স্কুলবেলার পিটি আর ওয়ার্ক এডুকেশনের বিভীষিকাময় দিনগুলো যেন ফিরে আসছে জীবনে।। খেলাধুলায় অষ্টরম্ভা ছিল জয়িতা। নেহাত পিটি টিচার অমিতাদির মেয়ের স্কুলের এসে লিখে দিত বলে ওকে প্রচুর নম্বর দিতেন দিদি। সেলাইটা ওর মন্দ লাগত না। তবে ধৈর্য্য থাকত না। ষাট, সত্তরেই খুশী থাকতে হতো।   রাগে গজগজ করতে করতে রিনিকা আর মহুলকে মীটিং রুমে ডাকল জয়িতা। রিনিকা ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনার কিছুই খায় না – তবে সবসময় স্ন্যাকিং করে।এখনো একটা ওটসের চিপসের প্যাকেট নিয়ে এসে বলল – “অসাম হেলদী আর টেস্টী এগুলো জয়ীদি। ট্রাই সাম।” এমনিতেই রাগে গা রি রি করছিল জয়িতার। “তুই খা। এখন মন দিয়ে শোন আমি কি বলছি। আর একটাও ভুল যেন না থাকে এবার।” 

ওদের দুজনকে কাজ বুঝিয়ে, গাড়ীতে স্টার্ট দিতে দিতে জয়িতার সব রাগ গিয়ে পড়ল মায়ের ওপর।  গোল্ড মেডালিস্ট মেয়েকে মা মোটে রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি। রান্নাবান্না নাকি শেখার কোন দরকার নেই। এখন হলো তো! গায়ের ঝাল ঝাড়তে ফোন করল মাকে। রিং হতে না হতেই মা ফোন ধরে উত্তেজিত হয়ে শুরু করল – “আরে তোর কথাই ভাবছিলাম। আজ  পৌষ সংক্রান্তি না! তাই পাটিসাপটা বানাচ্ছি। ফেরার পথে নিয়ে যাস। রমিত আর মিঙ্কি দুজনেই খুব ভালোবাসে।” 

“ও ওরাই তোমার সব না? আমার কথা ভাব তুমি কখনো? মা, বৌ ছাড়া আমার কোন ভূমিকা নেই না এই দুনিয়াতে?” – জয়িতা ঝাঁঝিয়ে উঠল। 

মেয়ের মুড খারাপ বুঝে নিয়ে মা গলা মোলায়েম করল – “আরে ওটা একটা কথার কথা। তোর জন্যেই  তো ভাজছি গরম গরম। আয়। এখানে বসেই  খাবি। আমি কফিও বসাচ্ছি। তারপর সবার জন্যেই প্যাকও করে দেব।” 

“আমি আসছি। তবে  আমি কারো জন্যে কোন প্যাকেট বইতে পারব না। যাদের ইচ্ছে তারা গিয়ে খেয়ে আসবে।” – গজগজ করে জয়িতা। 

“আচ্ছা বেশ। তাই হবে। তোকে কিছু নিয়ে যেতে হবে না। কাল রাত্তিরে সবাই এখানে খেয়ে যাস। হলো তো!” 

সেক্টর ফাইভ থেকে বেরিয়ে জয়িতা মায়ের বাড়ী যাওয়ার জন্যে করুণাময়ীর পথ ধরে। 

পাটিসাপটা খেতে খেতে মাকে নিজের সমস্যার কথা জানালো জয়িতা। মায়ের সহজ সরল সমাধান – “তা এগুলোই সাজিয়ে গুছিয়ে পোস্ট করে দে না। এতে তো নামমাত্র তেল আছে। সঙ্গে দুলাইন সংক্রান্তির ওপর লিখে দে। এ হলো গিয়ে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। তুই তো ভালো লিখতে পারিস। যা পাশের বাড়ী থেকে একটা কলাপাতা কেটে আন। আমি সাজিয়ে দিচ্ছি।”

“না মা – তোমার বানানো পাটিসাপটা পোষ্ট করে নিজের বলে চালাতে পারব না আমি।  তবে তোমার আইডিয়াটা খারাপ না। আমাকে একটু ভাবতে দাও।” – বলে জয়িতা সোফার ওপর গুছিয়ে বসে আগে বাড়িতে একটা ফোন করে, তারপর  রমিতকে। “আমার কাজ আছে। মায়ের বাড়ী এসেছি। তুমি বাড়ী চলে যাও। কবিতাদি আধ ঘণ্টার মধ্যেই বেরোবে। মিঙ্কির কিন্তু কাল জিওগ্রাফী টেস্ট আছে। দুজনে মিলে গেম খেলবে না। ওকে পড়াবে।”

“যো হুকুম ম্যাডাম” বলে রমিত ল্যাপটপ বন্ধ করে অফিস থেকে বেরোবার উদ্যোগ নেয়। 

ওর অফিস এক্সিস মলের পিছনে। মিঙ্কির জন্যে মোমো কিনে ও বাড়ীর পথ ধরে।   

জয়িতা কফিতে চুমুক দিতে দিতে ফোন নিয়ে গবেষণা করতে বসে পাটিসাপটাকে কি কি উপায়ে স্বাস্থ্যকর বানানো যায়। ওর স্বভাবসিদ্ধ বিচক্ষণতা নিয়ে ও প্রব্লেমটা টুকরো টুকরো করে ধাপে ধাপে এগোতে চায়। অঙ্ক আর কম্পিউটিং এর ছাত্রী, নিখুঁত হিসেব ছাড়া কোন কাজ করতে পারে না। প্রথমে জানতে হবে এক একটা পাটিসাপটায় কতটা খাদ্যগুণ আছে। বিংকে জিগ্যেস করতেই উত্তর এলো – এক একটা পাটিসাপটায় আছে ৫০ গ্রাম করে ময়দা, দুধ ও ঘী আর ২৫ গ্রাম করে নারকেল কোরা, চিনি আর ঘন দুধ। মোট ১৫০ ক্যালরি। ফাইবার যদিও নেই তবে আয়রণ, প্রোটিন, ভিটামিন ও বেশ কিছু মিনারালস আছে।  সঙ্গে এলো তরলা দালালের রেসিপি। সবকিছু নিক্তিতে মাপা।  এই পাক্কা হিসেবটা ওর কাজে লাগবে। 

এর পরের কাজ খুব সোজা। পাটিসাপটার পুষ্টিগুণ বাড়াতে এতে কি কি বদলানো যায় – সেটা ভাবতে হবে। 

“আচ্ছা মা – পাটিসাপটায় নারকেলের বদলে গাজরের পুর দিলে কেমন হয়? ফাইবার বাড়বে। প্রচুর বিটা – ক্যারোটিন।”  

শুনেই ওর মা মুখ বেঁকিয়ে বলল – “পাটিসাপটা করার  দরকার কি তোমার! গাজরের হালুয়া বানিয়ে পোস্ট করে দাও!”  

উত্তর ভারতীয় হালুয়ার কাছে বাংলার ঐতিহ্য হারানোর অভিমান মায়ের গলায় স্পষ্ট। নাঃ – নারকেলের পুরটা রাখতে হবে।

“তবে চিনির বদলে গুড় তো ব্যাবহার করা যায় – তাই না মা?” 

মায়ের মুখে এবার হাসি ফোটে – তাতে তৃপ্তি ও তাচ্ছিল্যের সংমিশ্রন –  “ও তোমার তরলা দালাল যাই বলুক, নারকেলের পুরে খেজুরের গুড়ই দেয়। ওটা বদলাতে তোমার এত গবেষণা না করলেও চলত!”

বিংকে জিজ্ঞেস করতেই  জানালো ২৫ গ্রাম চিনিতে কোন খাদ্যগুণ নেই, আছে কেবল ৯৭ ক্যালরি। কিন্তু ২৫ গ্রাম খেজুর গুড়ে ৯৩ ক্যালরির সাথে  আছে নানা রকম ভিটামিন, আয়রন, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, ম্যাগনেসিয়াম – মানে গোটা কেমিস্ট্রি বইটা। এও বলল যে শীতকালে খেজুর গুড় খেলে চুল ভালো হয়, কোষ্টকাঠিন্য দূর হয়, ইমিউনিটি বাড়ে। বিং এর বক্তব্য মাকে পড়ে শোনাতে মা স্বপ্নালু চোখে বলল – “বিং তো সবই জানে দেখছি। ছোটবেলায় সংক্রান্তির দিনগুলোতে  আমরা ভাত, রুটি খেতাম না। ওই পিঠে পুলি খেয়েই থাকতাম। কত রকম পিঠে করত মা, ঠাকুমা আর ফুল কাকীমা মিলে। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল গোকুল পিঠে। রাঙ্গা আলুর পিঠেও হতো। ফুল কাকীমা খুব সুন্দর দুধ পিঠে বানাত। দুধটা অনেকক্ষণ ধরে ঢিমে আঁচে জ্বাল দিয়ে ঘন করত বলে তার স্বাদই আলাদা ছিল। চার-পাঁচ দিন ধরে আমরা শুধু পিঠেই খেতাম। তার পরের কদিন পেটের যা হাল হতো, তাতে কোষ্টকাঠিন্য কয়েক মাইলের মধ্যে ঘেঁষতে পারত না।” 

এক্সেল শিটে পুরের সব তথ্য কপি পেষ্ট করে জয়িতা এবারের খোলসের ওপর মন দিল। যারা স্বাস্থ্য সচেতন তাদের কাছে ময়দা বিষতুল্য। ওর মা বলল – “ময়দার প্রচলন তো হালে হয়েছে। আমার ঠাকুমা, তোমার ঠাকুমা এঁরা তো চালগুঁড়ো দিয়েই করত।  তোর শাশুড়িও তো তাই করত। তবে চালের পাটিসাপটা কিন্তু চাটু থেকে তোলা খুব কঠিন।”

“চালটা এমনিতেও খুব একটা niche ব্যাপার নয় মা। হেলথ ফ্রীকরা চাল শুনলেই মুখে তুলবে না। তার বদলে রাগী বা অন্য কোন মিলেটের আটা দিয়ে করলে কেমন হয় বল তো?” 

“জানি না বাপু। আমার তো রাগী তিতকুটে লাগে। শোন তুমি রাগ করো না – তোমার বাবা বলতে বারণ করেছিল, তাও বলছি –  আগের বার তুমি যে রাগী আটার প্যাকেট দিয়ে গিয়েছিলে তোমার বাবার জন্যে – তা উনি মোটেও খাননি। চেহারা দেখেই নাকি খিদে চলে যায়। ওইসব হাবিজাবি তুমি আর কিনো না। নিজেরা তো খাবে না – তারপর আমাদের জোর করবে।” – বলতে বলতে জয়িতার মা কফির কাপগুলো নিয়ে রান্নাঘরে যাওয়ার জন্যে উঠল। আড়চোখে মেয়েকে দেখে মনে হল কানে কিছু ঢোকেনি। ভালোই হয়েছে।  জয়িতা তখন বিং এর দেওয়া গ্লুটেন ফ্রি আটার লিস্ট দেখছিল। হঠাৎ “ইউরেকা!” বলে চেঁচিয়ে ওঠাতে মায়ের হাত থেকে কাপগুলো পড়তে পড়তে বেঁচে গেল।   

“মা! এই দেখ! কাঁঠালের আটা। কাঁঠাল হলো গিয়ে সুপারফুড বুঝলে! এই আটা চাল, গম সব কিছুর থেকে অনেক বেশী হেলদী। ডায়েবেটিস এর রুগীদের আদর্শ খাবার। সোনালী রঙের আটা! উফফফ মা! থ্যাঙ্ক ইউ ফর দ্য ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া! আমি যাচ্ছি। এক্ষুনি গিয়ে সুইগীতে সব অর্ডার দেব। কালকেই বানিয়ে ফেলব। হিসেব করে দেখছি এটা দিয়ে পাটিসাপটা করলে এক একটায় মেরে কেটে ১২০  ক্যালরি হবে। সঙ্গে ফাইবার, প্রোটিন, মিনারালস, ভিটামিন – শরীরবন্ধু কাঁঠালের পাটিসাপটা। তারপর দেখি ক্লায়েন্ট মহুলের ওই বিস্বাদ স্যুপ খায় না আমার ঐতিহ্যময়ী পাটিসাপটা।”

মায়ের মুখেও বিজয়ীর হাসি। জামাই আর নাতনীর জন্যে পাটিসাপটার বাক্স মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিতে দিতে বলল  – “আমার বাবা কাঁঠালকে বলতেন গাছপাঁঠা। তবে তোর বিং বলছে সুপারপাঁঠা। ভালো! কাল রাত্রে এখানেই খাবি কিন্তু তোরা।” 

“বলতে পারছি না মা। পাটিসাপটা ঠিকঠাক হলে তোমাদের জন্যে নিয়ে আসব। নাহলে জানি না।” – বলতে বলতে জয়িতা গাড়ীর দিকে উড়ে যায়।   

———-

সকালে মিঙ্কিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে, অর্ণবকে মেইল পাঠিয়ে দেয় জয়িতা – “ওয়ার্কিং ফ্রম হোম অন এন ইনোভেটিভ  হেলদী রেসিপি।” অর্ণব খুব খুশি হয়ে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাঠায় – “আই হ্যাভ ফুল ফেইথ ইন ইঊ। বেস্ট অফ লাক।” কবিতাদিকে বলে সকাল সকাল রান্না শেষ করে রান্নাঘর খালি করে দিতে। কবিতাদি চাইলেও ওর থেকে কোনরকম সাহায্য নিতে রাজি হয় না জয়িতা। কবিতাদি তবু জিজ্ঞেস করে – “নারকেল কোড়াতে পারবে তুমি?”

“কোড়াব না তো – সুমেরুর প্যাকেট কিনেছি। একদম ফ্রেশ ফ্রোজেন নারকেল কোড়া।” 

“ফ্রিজের জিনিস আবার ফ্রেশ কি করে হয় জানি না! সে যাই হোকগে – কিন্তু  তুমি পাটিসাপটা তুলতে পারবে?” কবিতাদির সন্দেহ আর যায় না। 

“আরে বাবা পারব পারব। নতুন নন স্টীক প্যানও তো আছে একটা। তুমি যাও।” 

“আর মিঙ্কিকে বাসস্টপ থেকে কে আনবে?” – জিজ্ঞেস করে কবিতাদি। 

“আমি নিয়ে আসব – তুমি বাড়ী গিয়ে আরাম করো।” – বলে ওকে একপ্রকার ঠেলেই বার করে দেয় জয়িতা।     

ও কি একেবারেই আনকোরা নাকি রে বাবা! কবিতাদি ছুটি নিলে অম্লেট, ধোসা, চিলা এইসব করেনি নাকি কোনদিন?  একটু আধটু ভেঙ্গে গেলেও, একেবারে খাওয়ার অযোগ্য তো হয়নি। তাছাড়া অন্যায় সুবিধা নিতে ওর প্রিন্সিপালে লাগে। কোড হোক বা রান্না – অন্যের ক্রেডিট চুরি করে নিজের নামে চালানোতে ঘোর আপত্তি জয়িতার।  ওর মা ঠিকই বলে। মাথা থাকলে সব হয়। রান্না ব্যাপারটা তো অঙ্ক, ফিজিক্স আর কেমিস্ট্রিই রে বাবা। ধরে নিলেই হলো আজ সায়েন্স ল্যাবের পরীক্ষা। নিখুঁত ভাবে এক্সপেরিমেন্টটা নামাতে হবে। ব্যাস! 

ভাবতে ভাবতে জয়িতা আগে খানিকটা দুধ ঘন করে। তারপর বর্ফিলি নারকেল কোড়া প্যাকেট থেকে সোজা কড়াইতে দিয়ে, ঘন দুধ ও খেজুর গুড় সহ পুর তৈরি করে। একটু এলাচ গুঁড়োও দেয়। মা দেয় কি না জানা নেই – কিন্তু এই সব মশলার অনেক ভেষজ গুণ আছে। বিংকে জিগ্যেস করে জায়গামতো ঢুকিয়ে দিতে হবে।  এরপরেই আসল পরীক্ষা। একটা বড়ো পাত্রে কাঁঠালের আটা দুধে মিশিয়ে রেখেছে। মনটা একটু খচখচ করছিল। সংক্রান্তি তো নতুন ধান ওঠার আনন্দে উদযাপিত উৎসব। চালগুঁড়ো না দিলে ব্যাপারটা ঠিক অথেনটিক লাগছে না। ঐতিহ্যের প্রতি সততা বজায় রাখতে তাই গোলাতে দুচামচ চালগুঁড়োও মেশায়। এর জন্যে আবার একটু ক্যালরি কারেকশন করতে হবে। তা হোক। এই সময়ে মায়ের ফোন আসে – “শোন গোলাতেও একটু চিনি বা গুড় দিস কিন্তু। নাহলে খেতে ভালো লাগবে না। তাতে অবশ্য তোর ঠাকুমার মত ধবধবে সাদা পাটিসাপটা হবে না – তবে তোর ঠাকুমা তো ওপরে  গুড় মেশানো ক্ষীর ছড়িয়ে দিত। সেটাও করতে পারিস। দেখতেও খুব সুন্দর লাগে।” 

“ওইসব করলে আবার ক্ষীরের ক্যালরি আলাদা করে কষতে হবে মা। গোলার গুড় হিসেবে আছে। মেশাতে ভুলে গিয়েছিলাম যদিও – ভালো করলে তুমি ফোন করে। ব্যাস এবার আর ডিস্টার্ব করো না। আমাকে শান্তিতে ভাজতে দাও দেখি।” 

সঞ্জীভ কাপুরের সাইট থেকে কেনা  ধবধবে সাদা নন স্টীক প্যানে নামমাত্র তেল লাগে প্যানকেক করতে। আজ অবশ্য তেলের বদলে ঘী নিয়েছে ও পাটিসাপটা ভাজতে। সাদা তেলের চেয়ে ঘী এর উপকারিতা বেশী। এটাও বিংকে বলতে হবে ছোট্ট করে দুলাইন লিখে দিতে। সাদা প্যানে কাঁঠালের গোলা দিতে তা বেশ পরিমিত সুন্দরভাবে ছড়াল। দু চামচ করে পুর দিয়ে – তাকে দুপাশ দিয়ে মুড়তে গিয়ে সামান্য সমস্যা দেখা দিল। কাঁঠালের আটা ভারী নাজুক। হাল্কা হাতের খুন্তির ছোঁয়াতেও তাতে চিড় ধরছে। আরো সাবধানে – আরো আলতো হাতে ব্যাপারটা করতে হবে। যেমন করে সেন্সিটিভ ক্লায়েন্টদের ডীল করতে হয়। অমন অনেক করেছে জয়িতা। দু একটা তেড়িয়া ক্লায়েন্ট থাকলেও অধিকাংশকেই বশে এনে ফেলতে পেরেছে। আজও পারবে।  দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যায় জয়িতা। একবার হাত সেট হয়ে যেতেই সুন্দর উঠছে পাটিসাপটাগুলো।  

তবে রং দেখে একটু দমে গিয়েছিল প্রথমে। মায়ের পাটিসাপটাগুলো ছিল লালচে – সোনালী রঙের।  ওরগুলো ঘোর খয়েরী কাঁঠালের আটার রঙটাও অবশ্য ময়দার মত অত ফ্যাকফ্যেকে ফরসা ছিল না। অনেকটা বরং কোরা শাড়ির মতো। আগুনের তাপ লেগে রঙটা আরো পুড়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে চকোলেটের প্যানকেক। কোথায় যেন পড়েও ছিল – খেজুর গুড়কে বলা হয় বাংলার চকোলেট। সেটাই না হয় প্রয়োজনমত কাজে লাগিয়ে দেবে। 

সাদা পাথরের ট্রে বার করে তাতে কয়েক পিস পাটিসাপটা সাজিয়ে রাখতে কন্ট্রাস্টটা বেশ নজরকাড়া রূপ নিল।  তার ওপর ব্যাল্কনি থেকে দুটো গাঁদাফুল তুলে এনে রাখতেই – পুরো ব্যাপারটায় একটা এথনিক টাচ চলে এলো। বেশ একটা ভক্তিভাবপূর্ণ শ্যামলসুন্দর নিবেদন। ভক্তিটাও আজকাল চলছে। ঐ ব্যাপারটাও কাজে লেগে যেতে পারে। মনের ভেতর একটা বিদ্রোহী সুরও গুণগুণ করে বলছে – সব সুন্দর জিনিস সাদাই হতে হবে তার কোন মানে আছে! সাদার প্রতি এই দুর্বলতা কি ইংরেজদের প্রতি দাসত্বের মনোভাব থেকে নয়!  ছায়ার সাথে যুদ্ধ করার মতো নিজের সাথে খানিক সওয়াল জবাব চালিয়ে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে একটা কফি নিয়ে বসল জয়িতা।  একটা পাটিসাপটা ভেঙ্গে মুখে দিতে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো – বাঃ!  আর তক্ষনি এলার্ম ক্লকটা তীক্ষ্ণ স্বরে বেজে উঠতে চমকে উঠে দেখল তিনটে পাঁচ বাজে। মিঙ্কিকে বাস স্টপ থেকে আনতে হবে।  একটা পুরো পাটিসাপটা মুখে ঢুকিয়ে, লিফটে  নামতে নামতে  রমিতকে মেসেজ করে দিল – “আর্জেন্ট। প্লীজ কাম ফাস্ট।” 

মিঙ্কি জামাকাপড় ছেড়ে টেবিলে বসতে বসতেই রমিতও পৌঁছে গেল। ঘরে ঢুকেই সাদা ট্রেতে সাজানো পাটিসাপটা দেখে খপ করে একটা মুখে পুরে বলল – “মায়ের পাটিসাপটাগুলো কাল তোমার মত ফর্সা ছিল – আজ আমার মত কালো হয়ে গেল কি করে? খেতে কিন্তু খাসা হয়েছে। বলে দিও মাকে।” 

“তুমি শিওর? খেতে ভালো হয়েছে?” – জয়িতা দম বন্ধ করে জিগ্যেস করে। 

রমিত ওর দিকে অবাক হয়ে তাকায় – “মানে? এতে আবার শিওর না হওয়ার কী আছে? কালকেও তো দুটো খেয়েছি। সকালে একটা। হঠাৎ এরকম কূট প্রশ্ন কেন?” 

“এগুলো মায়ের বানানো নয়। এগুলো কাঁঠালের পাটিসাপটা। আমার বানানো।” 

রমিত জলের বোতল হাতে বিষম খেতে খেতে কোনরকমে সামলে বলে – “উফ! তুমি যা তা! পাইথন আর জাভার চক্করে সব ল্যাঙ্গুয়েজ ভুলে যাচ্ছ। কাঁঠালের আমসত্ত্ব বলে লোকে – পাটিসাপটা না। আর সোনার পাথরবাটি।”      

“সে যা খুশি বলুক। আই ডোন্ট কেয়ার। যাও এখন মিঙ্কিকে খাইয়ে দিয়ে, নিজে খেয়ে তাড়াতাড়ি অফিসে ফেরত যাও। রাত্রে মায়ের বাড়ীতে খাওয়া। তাড়াতাড়ি এসো।” – বলে জয়িতা ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে। 

রমিত একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করে – “মিঙ্কি তো নিজেই খেতে পারে। আমাকে ডাকলে কেন?”  

“পাটিসাপটা টেস্ট করতে। ভালো হয়েছে বুঝেছিলাম – তবে মায়ের মত হয়েছে ভাবিনি। ডবল চেক করলাম। আমাকে এখন  ব্যাপারটা জম্পেশ করে লিখে পোষ্ট করতে হবে বুঝলে?”  

“বুঝলাম!” – বলে রমিত খাবার জায়গা করে, খাবার দাবার বেড়ে মিঙ্কিকে নিয়ে গপ্পো জোড়ে। জয়িতার মুখেও মাছ দিয়ে মাখা ভাত চামচ করে গুঁজে দিচ্ছে মাঝে মাঝে।  খেতে খেতেই আবার সেলফিও তুলছে দুজনে। আনমনে চিবোতে চিবোতে নিজের লেখায় ডুবে যায় জয়িতা।  খানিকক্ষণ ধস্তাধস্তির পর এক ডজন লাইন লেখা হলো – 

“কুয়াশা ভেজা সকাল আর  মিঠে রোদের দুপুর,

কাশ্মীরী শাল, চিড়িয়াখানা – সঙ্গে খেজুর গুড় 

এসব যাদের মনের ভেতর – চিত্ত লোভাতুর

তাদের জন্যে সংক্রান্তি এবার স্বাস্থ্যতে ভরপুর।

মন থাকুক চিরসবুজ খেজুর গুড়ের রসে 

রক্তচাপ আর মধুমেহ থাক কাঁঠালের বশে। 

কাঁঠাল আটার পাটিসাপটা খান ভালবেসে 

ফাইবার্‌, প্রোটিন, ভিটামিন সবই আছে ঠেসে। 

সংক্রান্তির পিঠা যারা ভয়েই খান না 

নির্ভয়ে পাতে নিন এই খয়েরী পাটিসাপটা 

রূপ নয়কো গুণে মজুন – মনটা রাখুন তাজা 

আর কখনো বলবেন না পৌষ সর্বনাশা।” 

রেসিপি, ছবি ও ছড়া পোস্ট করে মিঙ্কির পাশে গিয়ে ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়ল জয়িতা। 

এর থেকে জয়েন্ট এন্ট্র্যান্স পরীক্ষা সহজ ছিল। 

————- 

মাস খানেক পেরিয়ে গেছে। গতানুগতিক জীবন চলছে যেমন চলে আর কি সব সংস্থায়।  জুনিয়র, সিনিয়ার সবাই এপ্রেইজালের চাপে বিধ্বস্ত। পুরনো ফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে নিজের এচিভমেন্টের লিস্ট তৈরি করতে ব্যাস্ত সবাই। হঠাৎ কোণের সীট থেকে  রিনিকা চিৎকার করে ওঠে – “ইয়েয়ে! জয়িদি তুমি ফার্স্ট, আমি সেকেন্ড। এটলাসের  সুমিত্র বসু থার্ড হয়েছে। রুচিরা আর সোমকও আছে টপ টেনে। রাসেল এবার হেলদিয়েস্ট  টীম।” সবাই হই হই করে সীট ছেড়ে এঈলে বেরিয়ে আসে।  অর্ণবও মেইলটা দেখেছে। একটা গভীর শ্বাস নিয়ে ভুঁড়িটাকে একটু চুপসে টীশার্টের ভেতরে এডজাস্ট করে ও কেবিন থেকে হাসি হাসি মুখে বেরিয়ে আসে টীমকে অভিনন্দন জানাতে। 

জয়িতাও নিজের টপটা টেনেটুনে সামনেটা একটু ফ্ল্যাট করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। ইউনিট জুড়ে হল্লা চলছে। সবাই অর্ণবকে ছেঁকে ধরেছে খাওয়ানোর জন্যে। মহুলের বেজার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু কষ্টই হয় জয়িতার। ওর কাছে গিয়ে বলে – “মন খারাপ করিস না। আমি তোর থেকে কয়েকটা অয়েলফ্রী রেসিপি নেবো বুঝলি। এবার থেকে নিজেই রান্না করব ভাবছি।” লোক দেখানো নয় – জয়িতা টের পাচ্ছে ওর ভেতরে বেশ একটা চনমনে ভাব খেলা করছে। শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে ফ্যাটগুলো যেন গলে গলে যাচ্ছে। বেশ মোটিভেটেড লাগছে। 

উচ্ছ্বাস একটু কমতে ও বাইরে বেরিয়ে রমিতকে ফোন করে।  ফোন তুলেই রমিত দ্বিগুণ উচ্ছ্বসিত গলায় বলে – “থ্যাঙ্ক ইউ! থ্যাঙ্ক ইউ!  কার কাছে খবর পেলে?” জয়িতা অবাক হয়ে জিগ্যেস করে – “কিসের খবর? কিসের থ্যাঙ্ক ইউ?”  রমিত লজ্জা মাখানো গলায় বলে – “আমি ভাবলাম তুমি আমায় বেস্ট পার্টনার অ্যাওয়ার্ডটার জন্যে কংগ্র্যাচুলেট করতে ফোন করলে।” 

“আমি ফোন করেছিলাম বলতে যে আমি হেলদিয়েস্ট রেসিপির জন্যে অ্যাওয়ার্ড পাচ্ছি। কিন্তু বেস্ট পার্টনার ব্যাপারটা কি শুনি? একজনের কটা পার্টনার থাকে যে সে বেস্ট পার্টনার বিচার করতে পারে? কারা তোমাকে বেস্ট পার্টনার ঘোষণা করল? কজনের পার্টনার তুমি?” – জয়িতার গলার স্বর যেন যুক্তি, তর্ক, বিস্ময়, অভিমান, রাগ সবকিছুর রঙিন ককটেল।     

রমিত মাথা চাপড়ে বলে –  “আরে আরে – এই মেয়েটা খালি অঙ্ক ভাবে! এই সব আমাদের এইচ আর এর কেরামতি! মনে আছে  তুমি যেদিন পাটিসাপটার ওপর কবিতা লিখছিলে, আমি মিঙ্কিকে খাওয়াতে খাওয়াতে কয়েকটা ছবি তুলেছিলাম?  তুমি ল্যাপটপে কাজ করছ, তোমার চুলে রোদ্দুর, আমি চামচে করে তোমাকে আর মিঙ্কিকে খাইয়ে দিচ্ছি, টেবিলে পাটিসাপটা, গাঁদাফুল – সব মিলিয়ে একটা জম্পেশ  রীল বানিয়ে পোস্ট করে দিয়েছিলাম কোম্পানির মিডিয়ায় – ক্যাপশন দিয়েছিলাম – Practice – don’t preach. Be the Change that you want! তো তাতে  নাকি এত  লাইক, লাভ পড়েছে যে কোম্পানি সেটা একটা বিজ্ঞাপণে ব্যবহার  করবে ভাবছে। তার জন্যেই এই অ্যাওয়ার্ড। বুঝলে?  আরে – তোমাকে তো congratulations বলাই হলো না। শোন  আজ আমরা আউধে ডিনার খেতে যাব। তোমার বসকেও নেমন্তন্ন করে দাও। বাই!” 

ফোনের কোঁ কোঁ আওয়াজ ছাপিয়ে জয়িতার কানে সহকর্মীদের উল্লাস ভেসে আসে।  ইউনিট ফাঁকা করে টীমের লোকজন বেরিয়ে আসছে – “জয়িতাদি চল চল – অর্ণবদা আমাদের খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছে। গণতান্ত্রিক শব্দভোটে মোমো আই এম ঠিক হয়েছে। ওদের পর্ক বেলিটা জাস্ট ফাটাফাটি!”      

কেবিন থেকে বেরোনোর আগে ঋতাকে একটা ফোন করে অর্ণব – “তোমার সুদীপ্তদা এবার আউট! আমরাই মোস্ট হেলদী টীম বুঝলে সুন্দরী!”

“আমি সুন্দরী সেটা আমি জানি। তবে সুদীপ্তদা কোন হিসেবে আমার, আর তুমিই বা কিভাবে হেলদিয়েস্ট – দুটোর কোনটাই বুঝলাম না।” 

“ভাবছি কাল থেকে জিমে যাব।” 

“বাঃ। তবে সুদীপ্তদার মতো নিজের খাবার-দাবার নিজে বানিয়ে নেবে বলে দিলাম। এমনিতেই অফিস সামলে  তিনজনের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, ডিনারের মেনু ঠিক করতে আমার দম বেড়িয়ে যায়। তার ওপর ওইসব এগ হোয়াইট অমলেট, ওটস, স্প্রাউট, ছোলা – মটর ওসব আমি খেতেও পারব না, বানাতেও পারব না।” 

“আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে জিম থাক।” 

ফোন রেখে অর্ণব বেশ নির্ভার বোধ করে।  ওর যে জিমে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না একথা আর কেউ বলতে পারবে না। চনমনে পায়ে লিফটের দিকে যায়। তারপর কি মনে হতে দিক বদলে  সিঁড়ি বেয়েই নামতেঁ শুরু করে তিনতলা থেকে । 

ব্যাগ, ল্যাপটপ গুছিয়ে নিয়ে লিফটে উঠে জয়িতার মনে হয় অদৃশ্য কিছু একটা ওকে ঘিরে আছে। লিফটে ও একাই। কোথাও কিছু নেই।  গাড়ীর দিকে হাঁটতে হাঁটতেও অস্বস্তি যেতে চায় না। মনে হয় ওর চারপাশে ধোঁয়া ধোঁয়া মেঘ। অথচ আকাশ উজ্জ্বল নীল। গ্রীষ্ম এখনো বসন্তকে পুরোপুরি গদিছাড়া করতে পারেনি। রূপোলী রোদ্দুরের রং এখনো জ্বলে যায়নি। হাঁটতে হাঁটতেই মাকে খবরটা দিল। এখনো মনে হচ্ছে মুখের ওপর যেন একটা সরের আস্তর।  আনমনে দু একবার সরাবার চেষ্টা করল। হাত শুকনো। কিছুই নেই। 

গাড়িতে বসে খুব লো ভলিউমে রেডিয়োটা চালিয়ে দিতেই মেদবিহীন তেলের বিজ্ঞাপণ আছড়ে পড়ল ভেতরে। আর তখনই – ওর চারপাশে ভেসে বেড়ানো মেঘলা রঙের অয়েল ফ্রি শুভ ইচ্ছাগুলোকে চিনতে পারল জয়িতা। ছোটবেলায় ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া সাবানের ফেনার মত রঙিন বিন্দুগুলো ওর গাল ছুঁয়ে, চোখ ছুঁয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে গাড়ীর ভেতর।  ইচ্ছেগুলো ধরাছোঁয়ার মধ্যে এলেই, এক হাত স্টিয়ারিঙে রেখে খুব সাবধানে অন্য হাত বাড়িয়ে ওদের মুঠোবন্দী করার চেষ্টা করছে জয়িতা। কিন্তু ধরতে গেলেই তারা মরীচিকার মত পিছলে পিছলে চলে যাচ্ছে অন্যত্র, যত্রতত্র।

4 comments

  1. উফফফ! ফাটাফাটি write up…সাথের ছবিটা excellent, mouthwatering! মনে মনে award দিয়েই দিলাম😊👏👏👏❤️

    Like

Leave your thoughts here